শনিবার, ৬ মে, ২০১৭

হাংরি আন্দোলন : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় কেন মুচলেকা দিয়ে পুলিশের সাক্ষী হয়েছিলেন । তাঁর নিজের কথায় ।

 সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়-এর স্বীকৃতি
সে-সময়ে আমাদের কেউই পাত্তা দিত না, যারা হাংরি আন্দোলন শুরু করে, সেই মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী আমাকে জানান যে আমার লেখা ওদের ভালো লেগেছে, ওরা যে-ধরণের লেখা ছাপতে চায়, তা নাকি আমার লেখায় ওরা দেখতে পেয়েছে, তাই আমার লেখা ওরা ছাপতে চায় । ওদের কাছে পাত্তা পেয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হয়েছিলুম ।
হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার আমি অনেক পরে দেখেছি । সে-সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল । বলতে গেলে সেই গল্পটার জন্যই আমি হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম । গল্পটার নাম আমার ঠিক মনে নেই । গল্পটা ছিল অনেকটা এইরকম -- একটা ছেলে, তাত ভীষণ খিদে । একদিন ছাত্রীকে পড়াতে-পড়াতে ছাত্রীর আঁচলের খুঁট খেতে শুরু করে । এইভাবে সে একটু-একটু করে পুরো শাড়িটা খেয়ে ফ্যালে । তাত তার বেশ ভালোই লাগে । তখন সে তার ছাত্রিকেই খেতে শুরু করে । একটু টক টক লাগে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো ছাত্রীকেই সে খেয়ে ফ্যালে । এ ব্যাপারটায় সে বেশ মজা পেয়ে যায় । এরপর থেকে সে অনেক কিছুই খেতে শুরু করে । যেমন জানালা, চেয়ার, ছাপাখানা, নোটবুক ইত্যাদি । একদিন এক হোটেলের সান্ত্রিকেই সে খেয়ে ফ্যালে । এই ছেলেটিই একদিন গঙ্গার ধারে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল । হঠাৎ তার সেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে । তখন সেই ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজকে খেতে যায় । কিন্তু সেই ছেলেটি জাহাজটাকে খেতে পারে না । জাহাজটা ছেড়ে দ্যায় । তখন সেই ছেলেটি একটা চিরকুট গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় । সেটা ঠিক কার উদ্দেশে ভাসিয়েছিল তা জানা জায় না । ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যেও হতে পারে ।  পৃথিবীর উদ্দেশ্যেও হতে পারে । বা অন্য কিছুও হতে পারে । এখানেই গল্পটা শেষ । এই গল্পটা আমাকে সেসময়ে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছে ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের এটিই মূল কথা ।
আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ --- আমার ভালো লেগেছিল এবং তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা-টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।
তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।
প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনো দিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার "বিজনের রক্তমাংস" গল্পটি বেরোনোর পর থেকে আমার সে-ভূমিকা অব্যাহত।
আমি মনে করো ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজের সমাজ, নিজেই সভ্যতা, এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্য সৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।
আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বলল যে, একেই তো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও, তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেজন্যই আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি । 
                                       
                      Sandipan Chattopadhyay as Police Witness
                           in Hungry Generation Trial in 1964