রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু সম্পর্কে বাসুদেব দাশগুপ্ত

অশোকনগর
৬.৮.৬৮
শৈলেশ্বর,
গতকাল সন্দীপনের বাড়িতে Operation ( আমার মতে ) বেশ ভালই হয়েছে । কিন্তু আজও পর্যন্ত আমার রাগ পড়েনি । রাগে কড়মড় করে উঠছে দাঁত । আমি আর আপ্পা সাড়ে নয়টার সময় গিয়ে পৌঁছাই -- গিয়েই দেখি বাড়ি নেই । ফিরে আসছে, এমন সময় উনি নামলেন এক রিক্সা থেকে । আবার ঘরে এসে বসা হলো ।আমি বললাম -- 'এদিকেই এসেছিলাম । আপনার কাছে এলাম টাকাটা নিতে । পকেটে পয়সা নেই ।'ব্যাটা কিছু আন্দাজ করে --'বেশ করেছেন, খুব ভালো করেছেন...' বলতে বলতে হাওয়া হয়ে গেল । বসেই আছি দুজনে, ঘরে আর আসে না । তারপর এক সময় এলে প্রথমেই আমার দিকে তাকিয়ে --'আমি আপনাকে একটা বই দেব ঠিক করেছিলাম--- লিস্টে নাম ছিল---কিন্তু যেহেতু "নিদ্রিত রাজীবলোচন" আপনার ভালো লাগেনি, সেজন্যে আর দেবো না' ।
আমি --- সত্য গুহকে আপনি যে কপিটা দিয়েছিলেন, আমি সেটা পড়েছি -- 'কে রবীন্দ্রনাথ' ছাড়া আর কিসসু আমার ভালো লাগেনি'।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আপ্পা -- 'আপনার বইটা স্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ফেললাম । কিছুই হয়নি -- আপনি ফুরিয়ে গেছেন মনে হলো।'
সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপন ফেটে পড়ল একেবারে । What do you mean by 'ফুরিয়ে গেছেন' ? বাসু বললে আমি সহ্য করবো । কিন্তু তুমি কী লিখেছ, কটা বই পড়েছ ?'
আপ্পা --'আমি পাঠক হিসেবে বলেছি, আর কটা বই পড়েছি, সে কৈফিয়ৎ আপনাকে দেবো কেন ?'
সন্দীপন--'দেবো না মানে... ইয়ার্কি ( হাত-পা ছুঁড়ে ) একি উত্তমকুমারের 'দেয়া নেয়া'...যে ফুরিয়ে গেছেন...তুমি কি মেয়েছেলে...ন্যাকা...দাঁত কেলিয়ে বললে 'ফুরিয়ে গেছেন'...মিচকের মতো তুমি হাসছিলে...একটা stray comment করলেই হলো ?' এবং আরো অনেককিছু...ওর চিৎকারে ঘর ফেটে যাচ্ছিল প্রায় । ব্যাপার দেখে আমি গম্ভীর হয়ে ---'আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন । ওকে simply আপনি বলতে পারেন তুমি বুঝতে পারোনি...আর তাছাড়া আমার অন্য একটা কথা ছিল...আপনি নাকি বলেছেন আমি "ক্ষুধার্ত" আপনাকে গছিয়েছি ? এবার সন্দীপন চৌকি ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে -- কে ? কে বলেছে ? আমি আপ্পাকে বলেছি ? কবে ? কোথায় ? এসব কী হচ্ছে...আপনারা কী চান স্পষ্ট করে বলুন...কী করতে চাইছেন আপনারা ?'
আমি বাধা দিয়ে --'আপনি বহুবচন ব্যবহার করবেন না..."আপনারা" বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন ?'
তারপর এইভাবে ঘটনা নিজপথে এগিয়ে চলে । মাঝখানে মনে হয়েছিল ও কেঁদে ফেলবে । তখন আমিও একটু নরম হই, সঙ্গে আপ্পাও । আপ্পা সাড়ে দশটার সময় চলে যায়। আমি সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত । সন্দীপন ওর বাড়িতে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল ...রাজি না হলে শেষ পর্যন্ত ২টাকা প্লাস ট্যাক্সি ভাড়া ৩টাকা দিয়ে দিয়েছে । আমি দিদির বাড়ি চলে এসেছি । অবনী ফিরেছে । লোকের ধাক্কায় গোটা দশেক খাবারসুদ্ধ 'ট্রে' ট্রেনের নীচে পড়ে গিয়েছিল । ফাইন দিতে হয়েছে ।
শনিবার দিন যাবার চেষ্টা করবো । ভালোবাসা রইলো । ইতি বাসুদেব ।
আর ভাল কথা...উৎপলকেও আমি মনের সাধ মিটিয়ে খিস্তি দিয়ে এসেছি ।

( শোনা যায় বাসুদেব দাশগুপ্ত অত্যন্ত মিথ্যাবাদী ছিলেন বিশেষত টাকার ব্যাপারে । চাকরি থেকে অবসর নেবার পর তিনি ভায়াগ্রার খোঁজ করে বেড়াতেন, সমীর রায়চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে । )

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ( ২০০২ ) "অর্ধেক জীবন" গ্রন্হে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে যা বলেছেন

দেশে ফেরার পর বেশ কিছু বন্ধুর উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেও বন্ধুত্বের ব্যাপারেই জীবনের প্রথম চরম আঘাতটাও পাই এই সময় । এর দু-এক দিনের মধ্যেই হাংরি জেনারেশনের সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ।  সমীর কলেজ জীবন থেকেই আমার বন্ধু, চাইবাসা-ডালটনগঞ্জে তার বাড়িতে কত দিন ও রাত কাটিয়েছি, বন্ধুকৃত্যে সে অতি উদার, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্হের প্রকাশকও সমীর । মলয়কেও চিনি তার ছোটবয়স থেকে । হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হয় আমার অনুপস্হিতিতে ও অজ্ঞাতসারে । সেই সময়কার ইংল্যাণ্ডের অ্যাংরি ইয়াং মেন আর আমেরিকার বিট জেনারেশন, এই দুই আন্দোলনের ধারা মিলিয়ে সম্ভবত হাংরি আন্দোলনের চিন্তা দানা বেঁধেছিল, হয়তো অ্যালেন গিন্সবার্গের প্রেরণাও ছিল কিছুটা এবং মুখ্য ভূমিকা ছিল মলয়ের ।

যেসব বন্ধুদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন ওঠাবসা, তারা একটা নতুন করতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ আমাকে বাদ দিয়ে ? এর কী কারণ থাকতে পারে, তা আমি কিছুই বুঝতে পারিনি । বন্ধুদের কাছে আমি অসহ্য হয়ে উঠেছি, কিংবা আমার হাতে নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কা ? একটা গভীর বেদনাবোধ আমি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম ।

আমার ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই কাকতালীয়ের মতন পুলিশ গ্রেপ্তার করে সমীর ও মলয়কে । তাতে কয়েকজন মনে করল আমিই ওদের ধরিয়ে দিয়েছি । যেন দমদমে পদার্পণ করেই আমি পুলিশ কমিশনারকে টেলিফোনে আদেশ করেছি, ওই কটাকে ধরে গারদে পুরুন তো !

পুলিশি তৎপরতার সূত্রপাতেই হাংরি জেনারেশনের প্রথম সারির নেতারা সবাই পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে জানিয়ে আসে, ভবিষ্যতে ওরা ওই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না । সমীরও ছাড়া পেয়ে যায়, মামলা হয় শুধু মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে, অশ্লীলতার অভিযোগে । সেই সময় মলয় খানিকটা একা হয়ে পড়ে । মামলা ওঠার আগে মলয় আমার বাড়িতে এসে অনুরোধ জানায় আমাকে তার পক্ষ নিয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে । আমি তৎক্ষণাত রাজি হয়ে জানিয়েছিলাম পৃথিবীর যে কোনো দেশেই সাহিত্যের ব্যাপারে পুলিশের হস্তক্ষেপের আমি বিরোধিতা করব ।

( যাঁরা  পুলিশর ভয়ে হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার ও মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার মুচলেকা দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ )
 

শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৬

হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রফিকুল ইসলামকে যা বলে গেছেন

                                                           
                                                                            




                                                      
                                                                           



                                    
                                                                            



                                      
                                                                              



শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬

মলয় রায়চৌধুরীকে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের চিঠি

২১/১ সেন্ট্রাল পার্ক
কলকাতা - ৩২
২.১২.১৯৬৫
প্রিয়বরেষু
কবিপত্রগুলির প্রাপ্তিলেখ জানানো হয়ে ওঠে না । তার অর্থ এই নয় যে আপনাদের আন্দোলন এবং তার অভিঘাত সম্পর্কে আমি নিশ্চেতন । বরং একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আপনারা যে বক্তব্য পৌঁছে দিতে চেয়েছেন, আমি তার নিহিতার্থ অনুমান করতে পারছি । আপনাদের বক্তব্য আমি স্বীকার করি না, কিন্তু বুঝতে পারি যে অনির্বাচিত মানবস্বভাব আপনাদের উপপাদ্য । প্রসঙ্গত জানাই, আপনার সমীক্ষাধর্মী প্রবন্ধ বা কবিতা সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলি ভাবনার একটা তাৎপর্য আছে বলে আমার মনে হয়েছে । কিন্তু এখন পর্যন্ত আপনাদের দলের সকল ( আপনাদের দল অবশ্য ভাঙন-গড়নের দোটানায় এতই অনিশ্চিত যে ওভাবে নির্ধারণ করতে যাওয়ার অসুবিধে আছে ) সদস্যদের কবিতায় আপনাদের প্রতিবাদমুখর নন্দনসংবিতের বলিষ্ঠতা এবং দার্শনিক ভঙ্গিটির ছাপ আমি খুঁজে পাইনি । আপনাদের নন্দনতত্ত্ব বোধহয় প্রায় তৈরি, কিন্তু কবিতা এতো দুর্বল, এতো অসহায় কেন ?
 আশা করি কুশলে আছেন । আমার প্রীতি ও শুভাকাঙ্খা জানবেন । শুভার্থী
                                        অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষের প্রিয় সোনাগাছির তিন যৌনকর্মী -- বেবি, মীরা ও দীপ্তি

৬ ডিসেম্বর ১৯৬৭
প্রিয় শৈলেশ্বর
খালসিটোলায় আপনাদের খুঁজতে যাই । ওখানে না পেয়ে কফিহাউসে, সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ( প্রায় ৭টা পর্যন্ত বা আরও বেশি ) আবার ট্যাক্সি করে সোনাগাছি এবং মীরার ঘরে আমরা ( আমি ও অবনী ধর ) ন'টা পর্যন্ত ছিলাম । ওইদিন অবনীর জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েই আমাকে অ্যাডভান্সের পুরো ১০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে । মীরাকে ৬০ টাকা দিয়েছে, খুব খুশি । বেবি এখন দশ নম্বর বাড়িতে । দীপ্তির অসুখ হয়েছে, চলে গেছে । ম্লান হয়ে গেছে ৫বি বাড়িটা ।
                                               ইতি বাসুদেব

 

বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

নবারুণ ভট্টাচার্য -- অভিজাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী

৬ই অক্টোবর ২০১৬ তারিখে তাঁর স্ট্যাটাসে অনুপম মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, "নবারুণ ভট্টাচার্যকে সেটাও সইতে হয়নি, যেটা হাংরি লেখকদের সইতে হয়েছে। 'হারবার্ট' বা 'কাঙাল মালসাট' কি হাংরিদের ডিকশন থেকে, মানসিকতা থেকে, বা আঙ্গিক থেকে উঠে আসছে না ? নবারুণ ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী এবং বিজন ভট্টাচার্যের সন্তান । বাংলা সাহিত্যের একেবারে ভেতরে তাঁর পারিবারিক পরিচয় । এই সুবিধেটা মলয় রায়চৌধুরীরা পাননি । নবারুণ শুরু থেকে বাস করেছেন সেই আবহাওয়ায় যেটার নাম ঋত্বিকতন্ত্র । নবারুণ জানতেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মিথ কী ভাবে গড়ে ওঠে, সেটাকে নিজের জীবনে তিনি দুর্দান্তভাবে প্রয়োগ করেছেন । আজ যখন মলয় রায়চৌধুরী 'কবিতীর্থ' বা 'মধ্যবর্তী'তে উপন্যাস লেখেন, তখন কেউ বলে ফ্যালেন, সেগুলো নবারুণের দ্বারা প্রভাবিত । কিন্তু উল্টোটাই কি ঠিক নয়?"

এই পোস্টের প্রসঙ্গে মলয় রায়চৌধুরী জানিয়েছেন যে "নবারুণ ওনার পত্রিকায় আমার লেখা ছাপতে চাননি । আমার 'নামগন্ধ' উপন্যাসে একটি চরিত্রের গাড়ি সেই থিয়েটারের সামনে থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল, যেখানে বিজন ভট্টাচার্য অভিনয় করছিলেন । আমার বাবা-মা কেউ স্কুলে পড়েননি, দুজনেই আঙ্গুঠাছাপ।"
উপরের দুটি বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে নবারুণ ভট্টাচার্য এবং মলয় রায়চৌধুরী বাঙালির দুটি বিপরীত সাংস্কৃতিক মেরুর নিবাসী ।এই প্রসঙ্গে যদি অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের সামাজিক ও আর্থিক ব্যাকগ্রাউণ্ডের কথা তোলা হয় তাহলে দেখা যাবে যে সুবিমল বসাকের বাবা ছিলেন একজন স্যাকরা, যিনি দারিদ্রের কারণে নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেন । দেবী রায় ছিলনের হাওড়ার একটি বস্তির একটি ঘরের ভাড়াটে, তাঁর মা প্রতিদিন বাজার থেকে কুড়িয়ে-আনা কুমড়োর বীজ শুকিয়ে বিক্রি করে দেবী রায় ও তাঁর ছেটো ভাইকে প্রতিপালন করেছিলেন । ফালগুনী রায় ছিলেন ধ্বসে যাওয়া এক পোড়োবাড়ির ছেলে যার সদস্যরা সেই বাড়ির মার্বেল পাথর তুলে-তুলে বিক্রি করে সংসার চালাতেন ; স্বাভাবিক যে উপযুক্ত খাওয়া-দাওয়া না পাবার কারণে অতি অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল । বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী ও সুবো আচার্য ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান । এনাদের কারোর বাবা-মা শিক্ষার সুযোগ পাননি এবং পশ্চিমবাংলায় এসে বেঁচে থাকার লড়াই লড়তে হয়েছিল ।
শংকর সেন লিখেছেন, "নবারুণবাবু ওনার পত্রিকায় একবার হাংরিদের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন ; সুতরাং মলয়বাবুর লেখা ওনার পত্রিকায় প্রকাশিত হবার প্রশ্ন ওঠে না । নবারুণবাবু ছিলেন অভিজাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী। বিজন ভট্টাচার্যের ছেলে, অভিজাত পরিবারের সন্তান, সোভিয়েত ও কমিউনিস্টদেশ ভ্রমণের সুযোগ-পাওয়া নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে হাংরি জেনারেশনের লেখকদের তুলনা করা উচিত নয় । কলকাতার যে চাকচিক্যময় সমাজে নবারুণবাবুর ঘোরাফেরা ছিল প্রতিদিনের ব্যাপার, সেখানে হাংরি জেনারেশনরা ছিল সম্পূর্ণ উটকো ।"ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস", "নামগন্ধ", "অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা" উপন্যাসগুলির অভিজ্ঞতার গভীরতা কলকাতাকেন্দ্রিক নবারুণবাবুর ছিল না । তিনি ছিলেন কলকাতার লেখক, কলকাতার অন্ধকার জগতের জন্য গড়ে-নেয়া ভাষার লেখক । মলয় রায়চৌধুরীর মতো ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না।"

এই প্রসঙ্গে উপযুক্ত মন্তব্য করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুতপা সেনগুপ্ত । তিনি বলেছেন, "আসলে নবারুণ মধ্যপন্হী । হাংরি জেনারেশনের টুলস নিয়ে জনপ্রিয় বয়ান ফেঁদেছেন।"
নবারুণ ভট্টাচার্যের মধ্যপন্হা অবলম্বন সম্পর্কে নয়নতারা দাশ বলেছেন, "নবারুণবাবু স্ট্যালিনের নরসংহার নিয়ে নিশ্চুপ । সিপিএমের খুনি দৌরাত্ম্য নিয়ে নিশ্চুপ । কেবল আনন্দবাজারকে আক্রমণ করে কি প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া যায় ? মলয় রায়চৌধুরী কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি । হয়তো উনি সেই জন্যই বড়ো প্রকাশক পাননি । প্রকৃত অর্থে হাংরি জেনারেশনরাই একমাত্র প্রতিষ্ঠানবিরোধী।"
উপরে উল্লিখিত বক্তব্যগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । কলকাতার ধনীদের কলোনি গল্ফগ্রিন নিবাসী নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন অভিজাত বাঙালি সমাজের অংশ, তাঁর পিতা ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা, তাঁর মা একজন প্রথিতযশা লেখিকা, তাঁর দাদু মনীশ ঘটক একজন কবি ও গল্পকার । তাঁকে স্বাভাবিকভাবে "প্রতিষ্ঠানবিরোধী" তকমা দিয়েছেন ওই অভিজাত বাঙালি সমাজের সদস্যরা । প্রতিষ্ঠানবিরোধী তকমা পেয়েও রাষ্ট্রের হাত থেকে ১৯৯৩ সালে "হারবার্ট" উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার নিতে তাঁর বিবেকে বাধেনি, যখন কিনা সেই রাষ্ট্রের তিনি অবিরাম সমালোচনা করেছেন, পুরন্দর ভট ছদ্মনামে তার বিরুদ্ধে অশ্লীল কবিতা লিখেছেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ২০০৩ সালে সাহিত্য অকাদেমির একটি পুরস্কার মলয় রায়চৌধুরী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । 
"ভাষাবন্ধন" নামে নবারুণবাবুর একটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ছিল, প্রতি বইমেলায় তিনি স্টল দিতেন । নাটকের ও ফিল্মের অভিজাত শ্রেনির মানুষদের সঙ্গে উঠতেন-বসতেন, আড্ডা দিতেন । সুমন মুখোপাধ্যায় "হারবার্ট" নিয়ে ফিল্ম করেছিলেন, "কাঙাল মালসাট" নিয়ে নাটক করেছিলেন । ওই সমাজের সদস্যেরা ছিল হাংরি জেনারেশনদের ধরাছোঁয়ার বাইরে । যেমন সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় হাংরি জেনারেশনকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য "বাইশে শ্রাবণ" ফিল্মে একটি পাগল চরিত্রকে হাংরি আন্দোলনের কবি হিসাবে উপস্হিত করেছিলেন, পরিচালক গৌতম ঘোষ অভিনীত সেই চরিত্রটি নাকি কলকাতার বইমেলায় আগুন ধরিয়েছিল !
এবারে আসা যাক নবারুণবাবুর স্ট্যালিনপ্রীতি নিয়ে । তিনি কোথাও উল্লেখ করেননি স্ট্যালিনের সোভিয়েত রাষ্ট্রে কবি-লেখকদের কী গতি করা হয়েছিল, অথচ তিনি সোভিয়েতদেশে গিয়েছেন । স্ট্যালিনের কাছ থেকে কবি-লেখক নিধনের গুরুমন্ত্র পেয়ে টিক্কা খান-ইয়াহিয়া খানরা স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, লাতিন আমেরিকাতেও শাসকরা স্ট্যালিনের গুরুমন্ত্র পেয়ে কবি-লেখকদের হত্যা করার ঐতিহ্য তৈরি করে ফেলেছে । নবারুণবাবু এগুলোর বিরোধিতা করেননি ।

সিপিএম যখন বর্ধমানে সাঁইবাড়ির ভাইদের হত্যা করে তাদের রক্তে মাখা ভাত তাদের মায়ের মুখে গুঁজে দিয়েছিল, তখন নবারুণ ভট্টাচার্য চুপ করেছিলেন । মরিচঝাঁপিতে দ্বীপ ঘিরে উদ্বাস্তুদের ওপর গুলি চালনার ও সমুদ্রে লাশ ফেলে দেবার নিন্দা করেননি । বিজন সেতুর উপরে সতেরোজন সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীর গায়ে পেট্রল ঢেলে জ্যান্তু পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি । সুচপুরের এগারোজন মুসলমান চাষিকে যখন ঘিরে ধরে খুন করা হলো তখন মুখ খোলেননি । বানতলায় মহিলা অফিসারদের জিপ থেকে টেনে নামিয়ে গণধর্ষণ ও খুন এবং একজনের যোনিতে টর্চ গুঁজে দেবার ঘটনা মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন।
হাংরি জেনারেশনের গল্প লেখক, অশোকনগর উদ্বাস্তু কলোনির নিবাসী, বাসুদেব দাশগুপ্ত উপরোক্ত ঘটনাগুলোর জন্য সিপিএম ত্যাগ করেছিলেন এবং ঘটনাগুলির বিরোধিতা করে পথসভায় বক্তৃতা করতেন, একথা জেনে যে তাঁকেও মারধর করা হতে পারে ।
                                        

বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৬

প্রদীপ চৌধুরী কর্তৃক হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা

                                                                          
                                                                             
                                                                           
                                                                              
                                                                          
                                                Pradip Choudhuri celebrates the funeral of
                                                       Hungry Generation Movement