বৃহস্পতিবার, ৮ মার্চ, ২০১৮

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসে পোস্টমডার্ন যৌনতা ( Postmodern Sexuality )

সময়ের সঙ্গে তাল দিয়ে নিজের ন্যারেটিভকে মেলাতে পারেন এমন ঔপন্যাসিক বাংলা ভাষায় হাতে গোনা যায় । এমনই একজন ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরী । তাঁর ' ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' সিরিজের সব কয়টি উপন্যাসে বর্তমান সময়ের যৌনতাকে ধরার প্রয়াস করেছেন মলয় । জয়িতা ভট্টাচার্যকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে 'ডুবজলে' থেকে 'প্রাকার পরিখা', এই পাঁচটি উপন্যাস মূলত একটিই উপন্যাস । যেহেতু লিটল ম্যাগাজিনে স্হান সংকুলান হয় না, সেহেতু তিনি উপন্যাসটিকে পাঁচটি অংশে ভেঙে লিখেছেন । 'ডুবজলে'র পর 'জলাঞ্জলি', 'নামগন্ধ', 'ঔরস' এবং 'প্রাকার পরিখা' । পাঁচটি উপন্যাসে ছড়ানো দীর্ঘ ন্যারেটিভে কোনো কেন্দ্রিয় চরিত্র বা প্রট্যাগনিস্ট নেই, নায়ক-নায়িকা নামক যৌনক্ষমতার দ্বৈত-বিভাজন নেই । 
ডুবজলে উপন্যাসে অতনু চক্রবর্তী তার অফিসের একটি বয়স্কা বিবাহিতা মহিলার সংস্পর্শে আসে, যার উদ্বৃত্ত পাপ্ম করা দুধ সে খেয়ে ফ্যালে, মহিলাটির প্রতি মাতৃত্বের বোধের কারণে ; পরে ঔরস এবং প্রাকার পরিখায় আমরা পাই অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে জঙ্গলে মাওবাদীদের মাঝে তারা দুজনে যৌন সম্পর্কে পাতিয়ে মহিলার স্বামীর উপস্হিতিতে জীবন কাটায় । এই অতনু চক্রবর্তী ব্যাঙ্কনোট নিয়ে মিজোরামে স্টেট ব্যাঙ্কে দিতে যায় এবং সেখানে বেশ কয়েক মাস দুইটি মিজো বোনের সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক গড়ে তোলে, মেয়ে দুটি একটি গোপন অতিথিশালায় যৌনকর্মী হিসাবে রোজগার করে । অতনু প্রতিরাতে দুই বোন, জুলি ও জুডিকে দুই পাশে নিয়ে শোয় এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গম করে । মিজোরামে যাবার পূর্বে অতনু চক্রবর্তী ভার্জিন তরুণ ছিল । মিজোরাম থেকে ফিরে এসে অতনু চক্রবর্তী তার অফিসের একদল কর্মীর যৌনজুয়ায় যোগ দেয় । এই জুয়ার জন্য অংশগ্রহণকারীরা টাকা দেয় এবং নালান্দার ধ্বাংসাবশেষে গিয়ে শেফালি নামে একটি অত্যন্ত কালো তরুণীকে খুঁজে বের করার খেলায় মাতে । অতনু শেফালিকে পায় না কিন্তু তরুণীটির প্রতি আকৃষ্ট হয় । পরবর্তী খেলা হয় শোনপুর মেলায়, জনৈক রাজপুত ট্রেড ইউনিয়ন নেতার স্ত্রীকে এই খেলার টোপ করা হয় কিন্তু অতনি জিততে পারে না, তার একজন সহকর্মী জেতে এবং নৌকায় ফুলশয্যার সময়ে সেই কর্মী, যে বউটিকে জিতেছে, সে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে । যৌনতার এই জুয়াখেলা মলয় রায়চৌধুরীর পূর্বে অন্য কোনো বাংলা উপন্যাসে আমরা পাই নাই ।
জলঞ্জলি উপন্যাসে একটি তরুণী অফিসার তার অধস্তন অফিসারের সঙ্গে উত্তরবিহারে ট্যুরে যায় । সেখানে হোটেলের সুবিধা না থাকায় তারা দুজনে এক মারোয়াড়ি ব্যাবসাদারের গেস্টহাউসে দুটি পৃথক ঘর পায় । যুবকটির ঘরের পেছন দিকে একটি পাকানো সিঁড়ি ছিল । সেই সিঁড়ি দিয়ে একদিন রাতে মারোয়াড়ি বাড়ির নিঃসন্তান বউ যুবকটির ঘরে ঢুকে তার লেপের তলায় শুয়ে পড়ে । তাদের যৌনসম্পর্কে প্রতিরাতে নিয়মিত হয়ে ওঠে । যুবকটি মারোয়াড়ি বউটির প্রেমে পড়ে কিন্তু বউটি অন্তঃসত্বা হবার পর যুবকটিকে জানিয়ে দেয় যে তার উদ্দেশ্যপূরণ হয়ে গেছে, বাড়ির কেউ আর সন্দেহ করতে পারবে না যে বউটি অন্য কারোর সঙ্গে শুয়েছিল । এটি বর্তমানকালের যৌনশোষণের ঘটনা যা প্রায়ই ঘটে চলে বর্তমান সমাজে । 
নামগন্ধ উপন্যাসে একটি বাচ্চা মুসলমান মেয়েকে জনৈক হিন্দু যুবক দেশভাগের সময়ে তুলে এনে তাকে হন্দু মেয়ের মতো বড়ো করে তোলে । যুবকটি নিজে বিয়ে করে না এবং মেয়েটিকেও বিয়ে করতে দেয় না । যারাই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছে তাদেরই খুন করিয়ে দিয়েছে যুবকটি । দুজনেই ভার্জিন থাকে এবং দুজনের মাঝে যৌনতাহীন ভার্জিনিটির সম্পর্ক বজায় থাকে। শেষ প্যারায় পাঠক জানতে পারেন যে খুশিরানি মণ্ডল প্রকৃতপক্ষে মিনহাজুদ্দিন খানের নাতনি খুশবু, যার ডাকনাম খুশি ।



তাঁর 'আঁস্তাকুড়ের এলেক্ট্রা' উপন্যাসে আমরা পাই শহরের আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেয়া একটি মেয়ের সঙ্গে তার অভিভাবকের যৌনসম্পর্ক, অথচ তার আগে এরেকটি যুবতী তাঁর জীবনে প্রবেশ করে জোর করে যৌনসম্পর্ক আদায় করে নিয়ে উধাও হয় ।
তাঁর 'নেক্রোপুরুষ' উপন্যাসে পাই যুবতীদের শবের সঙ্গে সঙ্গমের জন্য একজন মানুষ চারটি নেশাখোরকে পুষেছে যারা মর্গ থেকে যুবতীদের শব আনে এবং কাজ হয়ে গেলে আবার মর্গে রেখে আসে । একদিন যুবকটি বুঝতে পারে যে শবের সঙ্গে সে সঙ্গম করতে চলেছে সে প্রকৃতপক্ষে একজন জীবিত যুবতী যার মৃতা বোনের শবকে মর্গ থেকে তুলে আনা হয়েছিল।
মলয় রায়চৌধুরীর  'অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা' উপন্যাসে পাই একজন বিদেশিনীর সঙ্গে মাদক সেবনের পর বিভিন্ন জীবজন্তুর আঙ্গিকে সঙ্গম যা যুবকটি সেই বিদেশিনীর কাছ থেকেই শেখে । বিদেশিনী স্বদেশে ফিরে যাবার পর জনৈক গৃহবধু, যে কাশিতে মাদক বেচার ব্যাবসা করে সে ওই যুবকটিকে অনুসরন করে তার ডেরায় পৌঁছায় এবং যুবকটি বধূটির সঙ্গে জীবজন্তুর আঙ্গিকে সঙ্গম করে । এই সঙ্গমের দ্বারা যুবকটি বিস্টিয়ালিটির আশ্রয় নিয়ে বধূটিকেও আঙ্গিক শেখায় ।
মলয় রায়চৌধুরীর 'জঙ্গলরোমিও' উপন্যাসে প্রকৃত বিস্টিয়ালিটি পাই আমরা । কয়েকজন  দাগি অপরাধী ডুয়ার্সের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে তাদের যৌনতার আশ মেটায় ছাগল, হরিণ, শুয়োর ইত্যাদিকে ফাঁদ পেতে ধরে তাদের সঙ্গে নিয়মিত সঙ্গম করতে ।
যুগের সঙ্গে তাল দিয়ে যে মানুষের যৌনতা বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে তা মলয় রায়চৌধুরীর পূর্বে আর কোনো ঔপন্যাসিক লিখেছেন কিনা আমাদের জানা নেই । 
তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস 'প্রাকার পরিখা'য় দেখা যায় পরিত্যক্ত ছেলে অমিত প্রতিশোধ নেবার জন্য তার মায়ের সঙ্গে সঙ্গম করছে । তার মা তাকে একটি পরিবারে ছেড়ে চলে এসেছিল যেখানে অমিতকে চাকরের মতো কাজ করতে হতো । তার মা সন্তানকে ফেলে এসেছিল মাওবাদী দলে যোগ দেবার জন্য । অমিত একজন বয়স্কা মাওবাদী তেলুগু যুবতীর সঙ্গে জঙ্গল ছেড়ে পালায় ; তেলুগু যুবতীটির সঙ্গে অমিতের যৌনতার সম্পর্ক থাকলেও অমিত যুবতীটিকে মা বলে ডাকে ।
                                        

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন