মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৬

আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠি -- হাংরি জেনারেশন আন্দোলন

৭০৪ ইস্ট ফিফ্থ স্ট্রিট, নিউ ইয়র্ক, অ্যাপট ৫ এ
প্রিয় আবু সয়ীদ
          জঘন্য ! আপনার বাগাড়ম্বর আমায় বিভ্রান্ত করে তুলেছে, মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন, "আমার কোনও পদমর্যাদা নেই", এসব কথার মানে কী ? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড রয়েছে । কমিটির ভারতীয় এক্জিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে, ভারতে কমিটির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কেও আপনি ওয়াকিবহাল । চিনের ভারত আক্রমণের সময়ে আমি কলকাতায় একটি বড়সড় সমাবেশে উপস্হিত ছিলাম, যেখানে আপনার সহসম্পাদক শ্রীঅম্লান দত্ত সাংস্কৃতিক বর্বরতা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন । যা হোক, শ্রীবি ভি কার্নিককে আমি চিঠি লিখেছিলাম. যদিও আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতা কমিটির কোনও সদস্য বা কমিটির সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিরই কাজটি করা দরকার ছিল । আর বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি "আপত্তিকর উপাদান"-এর কথা । মশায়, আপনি ও পুলিশই একমাত্র সেগুলিকে আপত্তিকর বলছেন । সেগুলি নিছক আপত্তিকর তকমা পাওয়া উপাদান মাত্র, প্রকৃত আপত্তিকর নয় । পরের দিকে যে বলেছেন, "প্রশ্নাতীত আপত্তিকর", তা-ও নয় । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি, তাই তা এতোটুকুও "প্রশ্নাতীত" নয় । আসলে পুরোটাই হল রুচি, মতামত ইত্যাদির ব্যাপার । পুলিশ তাদের নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । আমার মতে এটি কালচারাল ফ্রিডাম বা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতারই বিষয় । আশা করছি, এ-বিষয়ে ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম, বিশেষ করে সেটির কলকাতা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা-ও একমত হবেন । আমার আরও অদ্ভুত লাগে জেনে যে, এক্ষেত্রে কারওকে সাহায্য করা মানে নবীন লেখকদের বলা, তাদের মতাদর্শ থেকে পিছু হটতে, নিজেদের অবস্হান পালটাতে, ইত্যাদি । ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো প্রমুখের ক্ষেত্রে যেরকম করা হয়েছিল সেরকমই একেবারে । এমনকী তাঁরা যে "ফালতু" লেখক, সেটাও । আমি আপনাকে ফের রাগাতে চাই না । আপনি ক্ষুব্ধ হন যাতেভ তেমন কিছু বলছি না । কিন্তু একটি কথা বলতেই হবে যে, বর্তমান ইশ্যু নিয়ে আমার-আপনার পত্রালাপ আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে ওই নবীন রুশ কবিরা কেন আপত্তিকর বা ফালতু, সেই নিয়ে রুশ আমলাদের সঙ্গে আমার কথোপকথন । "দায়িত্বহীন, নিম্ন মানের লেখা, নিম্ন রুচি।" ব্রডস্কির মামলার সময়ে, আপনার মনে থাকতে পারে, বিচারক প্রায় সারাক্ষণ ব্রডস্কিকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, "কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক কবে আপনার মর্ম স্বীকার করেছে।" বেচারা মলয়, -- যদি ও একজন নিম্ন মানের লেখকও হয় -- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সন্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম ।
          ওরা সকলেই সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন, জ্যোতির্ময় দত্ত যদি একথায় আপনার সহমত হয়, তাহলে ও আপনার আত্মগরিমা তুষ্ট করার জন্য সাধুতার ভান করেছে । দলের সবাই, ছাব্বিশজন যাদের জেরা করা হয়, সুনীল, উৎপল বসু, সন্দীপন, তারাপদ তো আছেই, এরা ছাড়াও অন্য যারা গ্রেপ্তার হয় সেই সব মধ্যমানের লেখকরা -- যদিও মলয়ের নির্যাতনের প্রতি প্রতিষ্ঠানের ক্রুদ্ধ মনোভাব দেখে মলয়ের নির্বুদ্ধিতার প্রতি আমার মমত্ব জাগছে -- এরা সবাই ফালতু এমন দাবি করা আপনার পক্ষে বা জ্যোতির পক্ষে অসম্ভব। কৃত্তিবাস-হাংরি গোষ্ঠীকে -- এই মামলায় যারা সকলেই পুলিশের দ্বারা হেনস্হা হয়েছে -- সমর্থন করেন এমন কোনো বাঙালি লেখক বা সমালোচককে যদি আপনি না চেনেন, তাহলে আপনার মতামত সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে । নিজেকে একদম আলাদা রেখে বুদ্ধদেব বসু তাদের গুণের স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেমন দিয়েছেন বিষ্ণু দে ও সমর সেন । আমি শুধু মলয় নয়, গোটা দলটার কথা বলছি ।
          এর পাশাপাশাই আপনার আরও একটা স্টেটমেন্ট আমায় অবাক করেছে। আপনি বলছেন, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধেও কংগ্রেসকে একইরকম ভূমিকা নিতে হবে, "আমি পর্তুগাল, স্পেন ও পাকিস্তানের কথা বলছিলাম"। এখনও পর্যন্ত আমার শোনা আপনার বক্তব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর ( আমার কাছে ) এটি । লরেন্স, ফ্যানি হিল, জেনে, বারোজ, মিলার, আপনাদের কামসূত্র, কোনারকের আলোকচিত্র -- এসব ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে ধারাবাহিকভাবে, বহুল প্রচারিত আইনি মামলা চলেছে, শায়েস্তা করার চেষ্টা চলেছে । এছাড়াও ফ্রান্সে একাধিক সংবাদপত্র ও আলজেরিয় যুদ্ধ বিষয়ক বই দমননীতির কোপে পড়েছে, পড়ছে । রাজনৈতিক কারণেই এই দমন । এমনকী কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামও এর কয়েকটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যদিও তা নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবেই । কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম সম্ভবত আয়রন কার্টেন দমননীতির বিরুদ্ধেই সরব হতে পছন্দ করে, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধে নয় -- আমার এ ধারণা আরও বেশি করে দৃঢ় হচ্ছে, বিশেষ করে আপনার প্রতিক্রিয়ার ধরন-ধারন দেখে । এই বিগত এক বছরেই নিউ ইয়র্ক শহরে চলচ্চিত্র, বই সংক্রান্ত পুলিশি ধরপাকড় তো হয়েইছে, এমনকী কমেডিয়ানরাও ( লেনি ব্রুস-এর ঘটনা ) বাদ যাননি । আমার মনে হয়, আপনার এ সম্পর্কে যতোটা জানা প্রয়োজন ততোটা আপনি জানেন না । ভদ্র ভাষায় বলতে তাই দাঁড়ায় আর কী । যেমন, আপনি কি জানেন যে, ইংরেজি ভাষায় যে প্রকাশক ডুরেল, মিলার, বারোজ, জেনে, নবোকভ, টেরি সাদার্ন, দ্য সাদে ও প্রাচ্য প্রণয়গাথা প্রকাশ করেছিল, সেই অলিম্পিয়া প্রেস ফরাসি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ? এ ব্যাপারে ফরাসি কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম কিছু করতে তেমন উৎসাহী ছিল তা নয় । অলিম্পয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া এক আন্তর্জাতিক কেচ্ছায় পরিণত হওয়ায় একটু নড়েচড়ে বসে তারা এখন একটা পিটিশন দিয়েছে । নিশ্চয়ই এটা জানেন যে, ভারতে লেডি চ্যাটার্লিজ নিষিদ্ধ ? ভারতীয় কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম কি এ বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছে ? হাংরি আন্দোলনকারীরা তো হাল আমলের ।
          যা হোক, এসবই তত্ত্বকথা, আমার ক্ষোভ উগরে দেয়া -- মতের বিনিময় -- ঈশ্বরের দোহাই, মাথা গরম করবেন না -- মলয় রায়চৌধুরী ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে আনা পুলিশের অভিযোগ মনে হয় এখনও রুজুই আছে -- মলয় লিখেছে যে এই ২৮ ডিসেম্বরই বিচার শুরু হবে -- এই অদ্ভুত পরিস্হিতি থেকে মুক্ত হবার মতো প্রবীণ লেখকদের কাছ থেকে কোনো সহায়তাই পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত --- ও বলেছে, বোধহয় ওর কথাগুলো সত্যিই, যে "আমাদের গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে কবি ও লেখকরা এতোটাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এখানে যে, তারা প্রায় সকলেই তাদের লেখার ধরণটাই পালটে ফেলেছে।" অবশ্যই যে লেখক দলকে ও চেনে, তাদের কথাই বলছে, "প্রতিষ্ঠিত" বয়স্কদের কথা নয় । ও লিখেছে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামকে চিঠি লিখেও কোনো উত্তর পায়নি ও । আপনিও এড়িয়ে গেছেন । আর "আমাদের গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাদের কোনো বুলেটিন বা ম্যাগাজিন আমরা ছাপাতেই পারছি না।"পুলিশের ভীতি । উৎপল বসু আজ একটি চিঠিতে লিখেছে, "ভীষণ বাজে খবর। আজ আমার কলেজ কর্তৃপক্ষ ( যেখানে আমি জিওলজি পড়াই ) আমায় পদত্যাগ করতে বলল । আমার কোনো যুক্তিই ওরা শুনতে নারাজ । আমার তো একরকম সর্বনাশ হয়ে গেল । ওরা "টাইম" পত্রিকা খুলে দেখিয়ে বলল : এই তো আপনার ছবি ও বক্তব্য । আপনার মতো কোনো লোক আমাদের এখানে থাকুন, এ আমরা চাই না । আমার চিঠিপত্র পুলিশ ইনটারসেপ্ট করছে । আপনি আমার শেষ চিঠিটি পেয়েছেন, ইত্যাদি।" এ একদম অসুস্হকর এক পরিস্হিতি । এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে প্রাথমিকভাবে আপনাকে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম । কারণ পুলিশি শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে । এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ । প্রবীণ দায়িত্ববান কোনো সদাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্পত্তি সম্ভব নয় । বোধহয় ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না । যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতা কংগ্রেসের দপ্তরে এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন । আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন । তবে চিঠিতে অন্তত আপনাকে সোজাসুজি কথাগুলো বলছি । এই মুহূর্তে আপনার-আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্হিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয় ।
          অনুগত -- অ্যালেন গিন্সবার্গ
পুনশ্চ : আমার বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী । পিটার অরলভস্কি ও আমি গত এক মাস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাদানে ব্যস্ত ছিলাম । আমি মাত্র কয়েকদিন আগেই কেমব্রিজ থেকে ফিরেছি ।

( মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলেন, কেননা তাঁরা জানতে পেরেছিলেন যে কলকাতার যাঁরা হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আবু সয়ীদ আইয়ুব অন্যতম । আবু সয়ীদ আইয়ুব মলয় ও সমীরের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেননি । কোনো তর্ক দিতে পারেননি । হিন্দি সাহিত্যিক ও ভারতীয় ইংরেজি লেখকদের চাপে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামকে বন্ধ করিয়ে দেন হাংরি আন্দোলনকারীরা, আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পাদিত "কোয়েস্ট" পত্রিকাও তাঁদের চাপে বন্ধ হয়ে যায় ।)
                  
Allen Ginsgerg Hungry Generation Abu Sayeed Ayyub Indian Congress for Cultural Freedom

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন