রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু সম্পর্কে বাসুদেব দাশগুপ্ত

অশোকনগর
৬.৮.৬৮
শৈলেশ্বর,
গতকাল সন্দীপনের বাড়িতে Operation ( আমার মতে ) বেশ ভালই হয়েছে । কিন্তু আজও পর্যন্ত আমার রাগ পড়েনি । রাগে কড়মড় করে উঠছে দাঁত । আমি আর আপ্পা সাড়ে নয়টার সময় গিয়ে পৌঁছাই -- গিয়েই দেখি বাড়ি নেই । ফিরে আসছে, এমন সময় উনি নামলেন এক রিক্সা থেকে । আবার ঘরে এসে বসা হলো ।আমি বললাম -- 'এদিকেই এসেছিলাম । আপনার কাছে এলাম টাকাটা নিতে । পকেটে পয়সা নেই ।'ব্যাটা কিছু আন্দাজ করে --'বেশ করেছেন, খুব ভালো করেছেন...' বলতে বলতে হাওয়া হয়ে গেল । বসেই আছি দুজনে, ঘরে আর আসে না । তারপর এক সময় এলে প্রথমেই আমার দিকে তাকিয়ে --'আমি আপনাকে একটা বই দেব ঠিক করেছিলাম--- লিস্টে নাম ছিল---কিন্তু যেহেতু "নিদ্রিত রাজীবলোচন" আপনার ভালো লাগেনি, সেজন্যে আর দেবো না' ।
আমি --- সত্য গুহকে আপনি যে কপিটা দিয়েছিলেন, আমি সেটা পড়েছি -- 'কে রবীন্দ্রনাথ' ছাড়া আর কিসসু আমার ভালো লাগেনি'।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আপ্পা -- 'আপনার বইটা স্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ফেললাম । কিছুই হয়নি -- আপনি ফুরিয়ে গেছেন মনে হলো।'
সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপন ফেটে পড়ল একেবারে । What do you mean by 'ফুরিয়ে গেছেন' ? বাসু বললে আমি সহ্য করবো । কিন্তু তুমি কী লিখেছ, কটা বই পড়েছ ?'
আপ্পা --'আমি পাঠক হিসেবে বলেছি, আর কটা বই পড়েছি, সে কৈফিয়ৎ আপনাকে দেবো কেন ?'
সন্দীপন--'দেবো না মানে... ইয়ার্কি ( হাত-পা ছুঁড়ে ) একি উত্তমকুমারের 'দেয়া নেয়া'...যে ফুরিয়ে গেছেন...তুমি কি মেয়েছেলে...ন্যাকা...দাঁত কেলিয়ে বললে 'ফুরিয়ে গেছেন'...মিচকের মতো তুমি হাসছিলে...একটা stray comment করলেই হলো ?' এবং আরো অনেককিছু...ওর চিৎকারে ঘর ফেটে যাচ্ছিল প্রায় । ব্যাপার দেখে আমি গম্ভীর হয়ে ---'আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন । ওকে simply আপনি বলতে পারেন তুমি বুঝতে পারোনি...আর তাছাড়া আমার অন্য একটা কথা ছিল...আপনি নাকি বলেছেন আমি "ক্ষুধার্ত" আপনাকে গছিয়েছি ? এবার সন্দীপন চৌকি ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে -- কে ? কে বলেছে ? আমি আপ্পাকে বলেছি ? কবে ? কোথায় ? এসব কী হচ্ছে...আপনারা কী চান স্পষ্ট করে বলুন...কী করতে চাইছেন আপনারা ?'
আমি বাধা দিয়ে --'আপনি বহুবচন ব্যবহার করবেন না..."আপনারা" বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন ?'
তারপর এইভাবে ঘটনা নিজপথে এগিয়ে চলে । মাঝখানে মনে হয়েছিল ও কেঁদে ফেলবে । তখন আমিও একটু নরম হই, সঙ্গে আপ্পাও । আপ্পা সাড়ে দশটার সময় চলে যায়। আমি সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত । সন্দীপন ওর বাড়িতে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল ...রাজি না হলে শেষ পর্যন্ত ২টাকা প্লাস ট্যাক্সি ভাড়া ৩টাকা দিয়ে দিয়েছে । আমি দিদির বাড়ি চলে এসেছি । অবনী ফিরেছে । লোকের ধাক্কায় গোটা দশেক খাবারসুদ্ধ 'ট্রে' ট্রেনের নীচে পড়ে গিয়েছিল । ফাইন দিতে হয়েছে ।
শনিবার দিন যাবার চেষ্টা করবো । ভালোবাসা রইলো । ইতি বাসুদেব ।
আর ভাল কথা...উৎপলকেও আমি মনের সাধ মিটিয়ে খিস্তি দিয়ে এসেছি ।

( শোনা যায় বাসুদেব দাশগুপ্ত অত্যন্ত মিথ্যাবাদী ছিলেন বিশেষত টাকার ব্যাপারে । চাকরি থেকে অবসর নেবার পর তিনি ভায়াগ্রার খোঁজ করে বেড়াতেন, সমীর রায়চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে । )

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ( ২০০২ ) "অর্ধেক জীবন" গ্রন্হে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে যা বলেছেন

দেশে ফেরার পর বেশ কিছু বন্ধুর উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেও বন্ধুত্বের ব্যাপারেই জীবনের প্রথম চরম আঘাতটাও পাই এই সময় । এর দু-এক দিনের মধ্যেই হাংরি জেনারেশনের সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ।  সমীর কলেজ জীবন থেকেই আমার বন্ধু, চাইবাসা-ডালটনগঞ্জে তার বাড়িতে কত দিন ও রাত কাটিয়েছি, বন্ধুকৃত্যে সে অতি উদার, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্হের প্রকাশকও সমীর । মলয়কেও চিনি তার ছোটবয়স থেকে । হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হয় আমার অনুপস্হিতিতে ও অজ্ঞাতসারে । সেই সময়কার ইংল্যাণ্ডের অ্যাংরি ইয়াং মেন আর আমেরিকার বিট জেনারেশন, এই দুই আন্দোলনের ধারা মিলিয়ে সম্ভবত হাংরি আন্দোলনের চিন্তা দানা বেঁধেছিল, হয়তো অ্যালেন গিন্সবার্গের প্রেরণাও ছিল কিছুটা এবং মুখ্য ভূমিকা ছিল মলয়ের ।

যেসব বন্ধুদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন ওঠাবসা, তারা একটা নতুন করতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ আমাকে বাদ দিয়ে ? এর কী কারণ থাকতে পারে, তা আমি কিছুই বুঝতে পারিনি । বন্ধুদের কাছে আমি অসহ্য হয়ে উঠেছি, কিংবা আমার হাতে নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কা ? একটা গভীর বেদনাবোধ আমি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম ।

আমার ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই কাকতালীয়ের মতন পুলিশ গ্রেপ্তার করে সমীর ও মলয়কে । তাতে কয়েকজন মনে করল আমিই ওদের ধরিয়ে দিয়েছি । যেন দমদমে পদার্পণ করেই আমি পুলিশ কমিশনারকে টেলিফোনে আদেশ করেছি, ওই কটাকে ধরে গারদে পুরুন তো !

পুলিশি তৎপরতার সূত্রপাতেই হাংরি জেনারেশনের প্রথম সারির নেতারা সবাই পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে জানিয়ে আসে, ভবিষ্যতে ওরা ওই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না । সমীরও ছাড়া পেয়ে যায়, মামলা হয় শুধু মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে, অশ্লীলতার অভিযোগে । সেই সময় মলয় খানিকটা একা হয়ে পড়ে । মামলা ওঠার আগে মলয় আমার বাড়িতে এসে অনুরোধ জানায় আমাকে তার পক্ষ নিয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে । আমি তৎক্ষণাত রাজি হয়ে জানিয়েছিলাম পৃথিবীর যে কোনো দেশেই সাহিত্যের ব্যাপারে পুলিশের হস্তক্ষেপের আমি বিরোধিতা করব ।

( যাঁরা  পুলিশর ভয়ে হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার ও মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার মুচলেকা দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ )
 

শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৬

হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রফিকুল ইসলামকে যা বলে গেছেন

                                                           
                                                                            




                                                      
                                                                           



                                    
                                                                            



                                      
                                                                              



শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬

মলয় রায়চৌধুরীকে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের চিঠি

২১/১ সেন্ট্রাল পার্ক
কলকাতা - ৩২
২.১২.১৯৬৫
প্রিয়বরেষু
কবিপত্রগুলির প্রাপ্তিলেখ জানানো হয়ে ওঠে না । তার অর্থ এই নয় যে আপনাদের আন্দোলন এবং তার অভিঘাত সম্পর্কে আমি নিশ্চেতন । বরং একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আপনারা যে বক্তব্য পৌঁছে দিতে চেয়েছেন, আমি তার নিহিতার্থ অনুমান করতে পারছি । আপনাদের বক্তব্য আমি স্বীকার করি না, কিন্তু বুঝতে পারি যে অনির্বাচিত মানবস্বভাব আপনাদের উপপাদ্য । প্রসঙ্গত জানাই, আপনার সমীক্ষাধর্মী প্রবন্ধ বা কবিতা সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলি ভাবনার একটা তাৎপর্য আছে বলে আমার মনে হয়েছে । কিন্তু এখন পর্যন্ত আপনাদের দলের সকল ( আপনাদের দল অবশ্য ভাঙন-গড়নের দোটানায় এতই অনিশ্চিত যে ওভাবে নির্ধারণ করতে যাওয়ার অসুবিধে আছে ) সদস্যদের কবিতায় আপনাদের প্রতিবাদমুখর নন্দনসংবিতের বলিষ্ঠতা এবং দার্শনিক ভঙ্গিটির ছাপ আমি খুঁজে পাইনি । আপনাদের নন্দনতত্ত্ব বোধহয় প্রায় তৈরি, কিন্তু কবিতা এতো দুর্বল, এতো অসহায় কেন ?
 আশা করি কুশলে আছেন । আমার প্রীতি ও শুভাকাঙ্খা জানবেন । শুভার্থী
                                        অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষের প্রিয় সোনাগাছির তিন যৌনকর্মী -- বেবি, মীরা ও দীপ্তি

৬ ডিসেম্বর ১৯৬৭
প্রিয় শৈলেশ্বর
খালসিটোলায় আপনাদের খুঁজতে যাই । ওখানে না পেয়ে কফিহাউসে, সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ( প্রায় ৭টা পর্যন্ত বা আরও বেশি ) আবার ট্যাক্সি করে সোনাগাছি এবং মীরার ঘরে আমরা ( আমি ও অবনী ধর ) ন'টা পর্যন্ত ছিলাম । ওইদিন অবনীর জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েই আমাকে অ্যাডভান্সের পুরো ১০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে । মীরাকে ৬০ টাকা দিয়েছে, খুব খুশি । বেবি এখন দশ নম্বর বাড়িতে । দীপ্তির অসুখ হয়েছে, চলে গেছে । ম্লান হয়ে গেছে ৫বি বাড়িটা ।
                                               ইতি বাসুদেব

 

বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

নবারুণ ভট্টাচার্য -- অভিজাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী

৬ই অক্টোবর ২০১৬ তারিখে তাঁর স্ট্যাটাসে অনুপম মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, "নবারুণ ভট্টাচার্যকে সেটাও সইতে হয়নি, যেটা হাংরি লেখকদের সইতে হয়েছে। 'হারবার্ট' বা 'কাঙাল মালসাট' কি হাংরিদের ডিকশন থেকে, মানসিকতা থেকে, বা আঙ্গিক থেকে উঠে আসছে না ? নবারুণ ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী এবং বিজন ভট্টাচার্যের সন্তান । বাংলা সাহিত্যের একেবারে ভেতরে তাঁর পারিবারিক পরিচয় । এই সুবিধেটা মলয় রায়চৌধুরীরা পাননি । নবারুণ শুরু থেকে বাস করেছেন সেই আবহাওয়ায় যেটার নাম ঋত্বিকতন্ত্র । নবারুণ জানতেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মিথ কী ভাবে গড়ে ওঠে, সেটাকে নিজের জীবনে তিনি দুর্দান্তভাবে প্রয়োগ করেছেন । আজ যখন মলয় রায়চৌধুরী 'কবিতীর্থ' বা 'মধ্যবর্তী'তে উপন্যাস লেখেন, তখন কেউ বলে ফ্যালেন, সেগুলো নবারুণের দ্বারা প্রভাবিত । কিন্তু উল্টোটাই কি ঠিক নয়?"

এই পোস্টের প্রসঙ্গে মলয় রায়চৌধুরী জানিয়েছেন যে "নবারুণ ওনার পত্রিকায় আমার লেখা ছাপতে চাননি । আমার 'নামগন্ধ' উপন্যাসে একটি চরিত্রের গাড়ি সেই থিয়েটারের সামনে থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল, যেখানে বিজন ভট্টাচার্য অভিনয় করছিলেন । আমার বাবা-মা কেউ স্কুলে পড়েননি, দুজনেই আঙ্গুঠাছাপ।"
উপরের দুটি বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে নবারুণ ভট্টাচার্য এবং মলয় রায়চৌধুরী বাঙালির দুটি বিপরীত সাংস্কৃতিক মেরুর নিবাসী ।এই প্রসঙ্গে যদি অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের সামাজিক ও আর্থিক ব্যাকগ্রাউণ্ডের কথা তোলা হয় তাহলে দেখা যাবে যে সুবিমল বসাকের বাবা ছিলেন একজন স্যাকরা, যিনি দারিদ্রের কারণে নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেন । দেবী রায় ছিলনের হাওড়ার একটি বস্তির একটি ঘরের ভাড়াটে, তাঁর মা প্রতিদিন বাজার থেকে কুড়িয়ে-আনা কুমড়োর বীজ শুকিয়ে বিক্রি করে দেবী রায় ও তাঁর ছেটো ভাইকে প্রতিপালন করেছিলেন । ফালগুনী রায় ছিলেন ধ্বসে যাওয়া এক পোড়োবাড়ির ছেলে যার সদস্যরা সেই বাড়ির মার্বেল পাথর তুলে-তুলে বিক্রি করে সংসার চালাতেন ; স্বাভাবিক যে উপযুক্ত খাওয়া-দাওয়া না পাবার কারণে অতি অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল । বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী ও সুবো আচার্য ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান । এনাদের কারোর বাবা-মা শিক্ষার সুযোগ পাননি এবং পশ্চিমবাংলায় এসে বেঁচে থাকার লড়াই লড়তে হয়েছিল ।
শংকর সেন লিখেছেন, "নবারুণবাবু ওনার পত্রিকায় একবার হাংরিদের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন ; সুতরাং মলয়বাবুর লেখা ওনার পত্রিকায় প্রকাশিত হবার প্রশ্ন ওঠে না । নবারুণবাবু ছিলেন অভিজাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী। বিজন ভট্টাচার্যের ছেলে, অভিজাত পরিবারের সন্তান, সোভিয়েত ও কমিউনিস্টদেশ ভ্রমণের সুযোগ-পাওয়া নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে হাংরি জেনারেশনের লেখকদের তুলনা করা উচিত নয় । কলকাতার যে চাকচিক্যময় সমাজে নবারুণবাবুর ঘোরাফেরা ছিল প্রতিদিনের ব্যাপার, সেখানে হাংরি জেনারেশনরা ছিল সম্পূর্ণ উটকো ।"ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস", "নামগন্ধ", "অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা" উপন্যাসগুলির অভিজ্ঞতার গভীরতা কলকাতাকেন্দ্রিক নবারুণবাবুর ছিল না । তিনি ছিলেন কলকাতার লেখক, কলকাতার অন্ধকার জগতের জন্য গড়ে-নেয়া ভাষার লেখক । মলয় রায়চৌধুরীর মতো ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না।"

এই প্রসঙ্গে উপযুক্ত মন্তব্য করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুতপা সেনগুপ্ত । তিনি বলেছেন, "আসলে নবারুণ মধ্যপন্হী । হাংরি জেনারেশনের টুলস নিয়ে জনপ্রিয় বয়ান ফেঁদেছেন।"
নবারুণ ভট্টাচার্যের মধ্যপন্হা অবলম্বন সম্পর্কে নয়নতারা দাশ বলেছেন, "নবারুণবাবু স্ট্যালিনের নরসংহার নিয়ে নিশ্চুপ । সিপিএমের খুনি দৌরাত্ম্য নিয়ে নিশ্চুপ । কেবল আনন্দবাজারকে আক্রমণ করে কি প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া যায় ? মলয় রায়চৌধুরী কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি । হয়তো উনি সেই জন্যই বড়ো প্রকাশক পাননি । প্রকৃত অর্থে হাংরি জেনারেশনরাই একমাত্র প্রতিষ্ঠানবিরোধী।"
উপরে উল্লিখিত বক্তব্যগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । কলকাতার ধনীদের কলোনি গল্ফগ্রিন নিবাসী নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন অভিজাত বাঙালি সমাজের অংশ, তাঁর পিতা ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা, তাঁর মা একজন প্রথিতযশা লেখিকা, তাঁর দাদু মনীশ ঘটক একজন কবি ও গল্পকার । তাঁকে স্বাভাবিকভাবে "প্রতিষ্ঠানবিরোধী" তকমা দিয়েছেন ওই অভিজাত বাঙালি সমাজের সদস্যরা । প্রতিষ্ঠানবিরোধী তকমা পেয়েও রাষ্ট্রের হাত থেকে ১৯৯৩ সালে "হারবার্ট" উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার নিতে তাঁর বিবেকে বাধেনি, যখন কিনা সেই রাষ্ট্রের তিনি অবিরাম সমালোচনা করেছেন, পুরন্দর ভট ছদ্মনামে তার বিরুদ্ধে অশ্লীল কবিতা লিখেছেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ২০০৩ সালে সাহিত্য অকাদেমির একটি পুরস্কার মলয় রায়চৌধুরী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । 
"ভাষাবন্ধন" নামে নবারুণবাবুর একটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ছিল, প্রতি বইমেলায় তিনি স্টল দিতেন । নাটকের ও ফিল্মের অভিজাত শ্রেনির মানুষদের সঙ্গে উঠতেন-বসতেন, আড্ডা দিতেন । সুমন মুখোপাধ্যায় "হারবার্ট" নিয়ে ফিল্ম করেছিলেন, "কাঙাল মালসাট" নিয়ে নাটক করেছিলেন । ওই সমাজের সদস্যেরা ছিল হাংরি জেনারেশনদের ধরাছোঁয়ার বাইরে । যেমন সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় হাংরি জেনারেশনকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য "বাইশে শ্রাবণ" ফিল্মে একটি পাগল চরিত্রকে হাংরি আন্দোলনের কবি হিসাবে উপস্হিত করেছিলেন, পরিচালক গৌতম ঘোষ অভিনীত সেই চরিত্রটি নাকি কলকাতার বইমেলায় আগুন ধরিয়েছিল !
এবারে আসা যাক নবারুণবাবুর স্ট্যালিনপ্রীতি নিয়ে । তিনি কোথাও উল্লেখ করেননি স্ট্যালিনের সোভিয়েত রাষ্ট্রে কবি-লেখকদের কী গতি করা হয়েছিল, অথচ তিনি সোভিয়েতদেশে গিয়েছেন । স্ট্যালিনের কাছ থেকে কবি-লেখক নিধনের গুরুমন্ত্র পেয়ে টিক্কা খান-ইয়াহিয়া খানরা স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, লাতিন আমেরিকাতেও শাসকরা স্ট্যালিনের গুরুমন্ত্র পেয়ে কবি-লেখকদের হত্যা করার ঐতিহ্য তৈরি করে ফেলেছে । নবারুণবাবু এগুলোর বিরোধিতা করেননি ।

সিপিএম যখন বর্ধমানে সাঁইবাড়ির ভাইদের হত্যা করে তাদের রক্তে মাখা ভাত তাদের মায়ের মুখে গুঁজে দিয়েছিল, তখন নবারুণ ভট্টাচার্য চুপ করেছিলেন । মরিচঝাঁপিতে দ্বীপ ঘিরে উদ্বাস্তুদের ওপর গুলি চালনার ও সমুদ্রে লাশ ফেলে দেবার নিন্দা করেননি । বিজন সেতুর উপরে সতেরোজন সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীর গায়ে পেট্রল ঢেলে জ্যান্তু পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি । সুচপুরের এগারোজন মুসলমান চাষিকে যখন ঘিরে ধরে খুন করা হলো তখন মুখ খোলেননি । বানতলায় মহিলা অফিসারদের জিপ থেকে টেনে নামিয়ে গণধর্ষণ ও খুন এবং একজনের যোনিতে টর্চ গুঁজে দেবার ঘটনা মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন।
হাংরি জেনারেশনের গল্প লেখক, অশোকনগর উদ্বাস্তু কলোনির নিবাসী, বাসুদেব দাশগুপ্ত উপরোক্ত ঘটনাগুলোর জন্য সিপিএম ত্যাগ করেছিলেন এবং ঘটনাগুলির বিরোধিতা করে পথসভায় বক্তৃতা করতেন, একথা জেনে যে তাঁকেও মারধর করা হতে পারে ।
                                        

বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৬

প্রদীপ চৌধুরী কর্তৃক হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা

                                                                          
                                                                             
                                                                           
                                                                              
                                                                          
                                                Pradip Choudhuri celebrates the funeral of
                                                       Hungry Generation Movement

মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৬

সুভাষ ঘোষ-এর কুখ্যাত মুচলেকা -- হাংরি জেনারেশন আন্দোলন

আমার নাম সুভাষ ঘোষ । গত এক বৎসর যাবত আমি কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে যাতায়াত করছি । সেখানে আমার সঙ্গে একদিন হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবক মলয় রায়চৌধুরীর পরিচয় হয় । সে আমার কাছ থেকে একটা লেখা চায় । হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের কথা আমি জানি, কিন্তু হাংরি আন্দোলনের যে ঠিক কী উদ্দেশ্য তা আমি জানি না । আমি তাকে আমার একটা লেখা দিই যা দেবী রায় সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । আমি তা আমার রুমমেট শৈলেশ্বর ঘোষের কাছ থেকে পাই । সে হাংরি বুলেটিনের একটা প্যাকেট পেয়েছিল । আমি এই ধরণের আন্দোলনের সঙ্গে কখনও জড়াতে চাইনি, যা আমার মতে খারাপ । আমি ভাবতে পারি না যে এরকম একটা পত্রিকায় আমার আর্টিকেল "হাঁসেদের প্রতি" প্রকাশিত হবে ।
আমি হাংরি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাস করি না, আর এই লেখাটা প্রকাশ হবার পর আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছি ।
                                                         স্বাক্ষর : সুভাষচন্দ্র ঘোষ
                                                        ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪

                             
                                      সুভাষ ঘোষ Subhash Ghose

( হাংরি জেনারেশন মোকদ্দমায় সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষী হয়েছিলেন এবং মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন । )

আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠি -- হাংরি জেনারেশন আন্দোলন

৭০৪ ইস্ট ফিফ্থ স্ট্রিট, নিউ ইয়র্ক, অ্যাপট ৫ এ
প্রিয় আবু সয়ীদ
          জঘন্য ! আপনার বাগাড়ম্বর আমায় বিভ্রান্ত করে তুলেছে, মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন, "আমার কোনও পদমর্যাদা নেই", এসব কথার মানে কী ? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড রয়েছে । কমিটির ভারতীয় এক্জিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে, ভারতে কমিটির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কেও আপনি ওয়াকিবহাল । চিনের ভারত আক্রমণের সময়ে আমি কলকাতায় একটি বড়সড় সমাবেশে উপস্হিত ছিলাম, যেখানে আপনার সহসম্পাদক শ্রীঅম্লান দত্ত সাংস্কৃতিক বর্বরতা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন । যা হোক, শ্রীবি ভি কার্নিককে আমি চিঠি লিখেছিলাম. যদিও আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতা কমিটির কোনও সদস্য বা কমিটির সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিরই কাজটি করা দরকার ছিল । আর বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি "আপত্তিকর উপাদান"-এর কথা । মশায়, আপনি ও পুলিশই একমাত্র সেগুলিকে আপত্তিকর বলছেন । সেগুলি নিছক আপত্তিকর তকমা পাওয়া উপাদান মাত্র, প্রকৃত আপত্তিকর নয় । পরের দিকে যে বলেছেন, "প্রশ্নাতীত আপত্তিকর", তা-ও নয় । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি, তাই তা এতোটুকুও "প্রশ্নাতীত" নয় । আসলে পুরোটাই হল রুচি, মতামত ইত্যাদির ব্যাপার । পুলিশ তাদের নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । আমার মতে এটি কালচারাল ফ্রিডাম বা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতারই বিষয় । আশা করছি, এ-বিষয়ে ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম, বিশেষ করে সেটির কলকাতা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা-ও একমত হবেন । আমার আরও অদ্ভুত লাগে জেনে যে, এক্ষেত্রে কারওকে সাহায্য করা মানে নবীন লেখকদের বলা, তাদের মতাদর্শ থেকে পিছু হটতে, নিজেদের অবস্হান পালটাতে, ইত্যাদি । ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো প্রমুখের ক্ষেত্রে যেরকম করা হয়েছিল সেরকমই একেবারে । এমনকী তাঁরা যে "ফালতু" লেখক, সেটাও । আমি আপনাকে ফের রাগাতে চাই না । আপনি ক্ষুব্ধ হন যাতেভ তেমন কিছু বলছি না । কিন্তু একটি কথা বলতেই হবে যে, বর্তমান ইশ্যু নিয়ে আমার-আপনার পত্রালাপ আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে ওই নবীন রুশ কবিরা কেন আপত্তিকর বা ফালতু, সেই নিয়ে রুশ আমলাদের সঙ্গে আমার কথোপকথন । "দায়িত্বহীন, নিম্ন মানের লেখা, নিম্ন রুচি।" ব্রডস্কির মামলার সময়ে, আপনার মনে থাকতে পারে, বিচারক প্রায় সারাক্ষণ ব্রডস্কিকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, "কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক কবে আপনার মর্ম স্বীকার করেছে।" বেচারা মলয়, -- যদি ও একজন নিম্ন মানের লেখকও হয় -- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সন্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম ।
          ওরা সকলেই সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন, জ্যোতির্ময় দত্ত যদি একথায় আপনার সহমত হয়, তাহলে ও আপনার আত্মগরিমা তুষ্ট করার জন্য সাধুতার ভান করেছে । দলের সবাই, ছাব্বিশজন যাদের জেরা করা হয়, সুনীল, উৎপল বসু, সন্দীপন, তারাপদ তো আছেই, এরা ছাড়াও অন্য যারা গ্রেপ্তার হয় সেই সব মধ্যমানের লেখকরা -- যদিও মলয়ের নির্যাতনের প্রতি প্রতিষ্ঠানের ক্রুদ্ধ মনোভাব দেখে মলয়ের নির্বুদ্ধিতার প্রতি আমার মমত্ব জাগছে -- এরা সবাই ফালতু এমন দাবি করা আপনার পক্ষে বা জ্যোতির পক্ষে অসম্ভব। কৃত্তিবাস-হাংরি গোষ্ঠীকে -- এই মামলায় যারা সকলেই পুলিশের দ্বারা হেনস্হা হয়েছে -- সমর্থন করেন এমন কোনো বাঙালি লেখক বা সমালোচককে যদি আপনি না চেনেন, তাহলে আপনার মতামত সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে । নিজেকে একদম আলাদা রেখে বুদ্ধদেব বসু তাদের গুণের স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেমন দিয়েছেন বিষ্ণু দে ও সমর সেন । আমি শুধু মলয় নয়, গোটা দলটার কথা বলছি ।
          এর পাশাপাশাই আপনার আরও একটা স্টেটমেন্ট আমায় অবাক করেছে। আপনি বলছেন, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধেও কংগ্রেসকে একইরকম ভূমিকা নিতে হবে, "আমি পর্তুগাল, স্পেন ও পাকিস্তানের কথা বলছিলাম"। এখনও পর্যন্ত আমার শোনা আপনার বক্তব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর ( আমার কাছে ) এটি । লরেন্স, ফ্যানি হিল, জেনে, বারোজ, মিলার, আপনাদের কামসূত্র, কোনারকের আলোকচিত্র -- এসব ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে ধারাবাহিকভাবে, বহুল প্রচারিত আইনি মামলা চলেছে, শায়েস্তা করার চেষ্টা চলেছে । এছাড়াও ফ্রান্সে একাধিক সংবাদপত্র ও আলজেরিয় যুদ্ধ বিষয়ক বই দমননীতির কোপে পড়েছে, পড়ছে । রাজনৈতিক কারণেই এই দমন । এমনকী কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামও এর কয়েকটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যদিও তা নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবেই । কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম সম্ভবত আয়রন কার্টেন দমননীতির বিরুদ্ধেই সরব হতে পছন্দ করে, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধে নয় -- আমার এ ধারণা আরও বেশি করে দৃঢ় হচ্ছে, বিশেষ করে আপনার প্রতিক্রিয়ার ধরন-ধারন দেখে । এই বিগত এক বছরেই নিউ ইয়র্ক শহরে চলচ্চিত্র, বই সংক্রান্ত পুলিশি ধরপাকড় তো হয়েইছে, এমনকী কমেডিয়ানরাও ( লেনি ব্রুস-এর ঘটনা ) বাদ যাননি । আমার মনে হয়, আপনার এ সম্পর্কে যতোটা জানা প্রয়োজন ততোটা আপনি জানেন না । ভদ্র ভাষায় বলতে তাই দাঁড়ায় আর কী । যেমন, আপনি কি জানেন যে, ইংরেজি ভাষায় যে প্রকাশক ডুরেল, মিলার, বারোজ, জেনে, নবোকভ, টেরি সাদার্ন, দ্য সাদে ও প্রাচ্য প্রণয়গাথা প্রকাশ করেছিল, সেই অলিম্পিয়া প্রেস ফরাসি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ? এ ব্যাপারে ফরাসি কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম কিছু করতে তেমন উৎসাহী ছিল তা নয় । অলিম্পয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া এক আন্তর্জাতিক কেচ্ছায় পরিণত হওয়ায় একটু নড়েচড়ে বসে তারা এখন একটা পিটিশন দিয়েছে । নিশ্চয়ই এটা জানেন যে, ভারতে লেডি চ্যাটার্লিজ নিষিদ্ধ ? ভারতীয় কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম কি এ বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছে ? হাংরি আন্দোলনকারীরা তো হাল আমলের ।
          যা হোক, এসবই তত্ত্বকথা, আমার ক্ষোভ উগরে দেয়া -- মতের বিনিময় -- ঈশ্বরের দোহাই, মাথা গরম করবেন না -- মলয় রায়চৌধুরী ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে আনা পুলিশের অভিযোগ মনে হয় এখনও রুজুই আছে -- মলয় লিখেছে যে এই ২৮ ডিসেম্বরই বিচার শুরু হবে -- এই অদ্ভুত পরিস্হিতি থেকে মুক্ত হবার মতো প্রবীণ লেখকদের কাছ থেকে কোনো সহায়তাই পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত --- ও বলেছে, বোধহয় ওর কথাগুলো সত্যিই, যে "আমাদের গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে কবি ও লেখকরা এতোটাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এখানে যে, তারা প্রায় সকলেই তাদের লেখার ধরণটাই পালটে ফেলেছে।" অবশ্যই যে লেখক দলকে ও চেনে, তাদের কথাই বলছে, "প্রতিষ্ঠিত" বয়স্কদের কথা নয় । ও লিখেছে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামকে চিঠি লিখেও কোনো উত্তর পায়নি ও । আপনিও এড়িয়ে গেছেন । আর "আমাদের গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাদের কোনো বুলেটিন বা ম্যাগাজিন আমরা ছাপাতেই পারছি না।"পুলিশের ভীতি । উৎপল বসু আজ একটি চিঠিতে লিখেছে, "ভীষণ বাজে খবর। আজ আমার কলেজ কর্তৃপক্ষ ( যেখানে আমি জিওলজি পড়াই ) আমায় পদত্যাগ করতে বলল । আমার কোনো যুক্তিই ওরা শুনতে নারাজ । আমার তো একরকম সর্বনাশ হয়ে গেল । ওরা "টাইম" পত্রিকা খুলে দেখিয়ে বলল : এই তো আপনার ছবি ও বক্তব্য । আপনার মতো কোনো লোক আমাদের এখানে থাকুন, এ আমরা চাই না । আমার চিঠিপত্র পুলিশ ইনটারসেপ্ট করছে । আপনি আমার শেষ চিঠিটি পেয়েছেন, ইত্যাদি।" এ একদম অসুস্হকর এক পরিস্হিতি । এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে প্রাথমিকভাবে আপনাকে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম । কারণ পুলিশি শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে । এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ । প্রবীণ দায়িত্ববান কোনো সদাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্পত্তি সম্ভব নয় । বোধহয় ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না । যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতা কংগ্রেসের দপ্তরে এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন । আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন । তবে চিঠিতে অন্তত আপনাকে সোজাসুজি কথাগুলো বলছি । এই মুহূর্তে আপনার-আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্হিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয় ।
          অনুগত -- অ্যালেন গিন্সবার্গ
পুনশ্চ : আমার বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী । পিটার অরলভস্কি ও আমি গত এক মাস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাদানে ব্যস্ত ছিলাম । আমি মাত্র কয়েকদিন আগেই কেমব্রিজ থেকে ফিরেছি ।

( মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলেন, কেননা তাঁরা জানতে পেরেছিলেন যে কলকাতার যাঁরা হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আবু সয়ীদ আইয়ুব অন্যতম । আবু সয়ীদ আইয়ুব মলয় ও সমীরের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেননি । কোনো তর্ক দিতে পারেননি । হিন্দি সাহিত্যিক ও ভারতীয় ইংরেজি লেখকদের চাপে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামকে বন্ধ করিয়ে দেন হাংরি আন্দোলনকারীরা, আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পাদিত "কোয়েস্ট" পত্রিকাও তাঁদের চাপে বন্ধ হয়ে যায় ।)
                  
Allen Ginsgerg Hungry Generation Abu Sayeed Ayyub Indian Congress for Cultural Freedom

অ্যালেন গিন্সবার্গকে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেখা আবু সঈদ আইয়ুব-এর চিঠি

পার্ল রোড, কলকাতা, 
৩১ অক্টোবর ১৯৬৪
প্রিয় শ্রীগিন্সবার্গ
          আপনার ১৩ তারিখের উদ্দেশ্যহীন অবমাননাকর চিঠি পেয়ে আমি বিস্মিত । আপনি যে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডমকে কমিউনিস্টদের দ্বারা চিহ্ণিত একটি জোচ্চোর বুলশিট উদারনৈতিক আঁতেলদে কমিউনিস্টবিরোধী সিনডিকেট বলে মনে করেন, তাতে আমি অবাক হইনি ; কেননা আমি কখনও কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামকে আপনার লেবেল 'বুর্জোয়া' কিংবা 'শ্রদ্ধেয়' থেকে মুক্ত করার কথা ভাবিনি ।
          যদি কোনো পরিচিত ভারতীয় সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবি তাদের সাহিত্যিক বা বৌদ্ধিক কাজের জন্য পুলিশের অবদমনের শিকার হতো , আমি নিশ্চিত যে ভারতীয় কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম আপনার অপমানজনক ওসকানি ছাড়াই হস্তক্ষেপ করতো ।  আমি আপনাকে জানিয়ে আনন্দিত যে তেমন কোনো কিছুই সাম্প্রতিককালে এদেশে ঘটেনি । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর হাংরি জেনারেশনের তরুণ বন্ধুরা, আমার জ্ঞানমতে তেমন কোনো রচনা লিখে উঠতে পারেনি, যদিও তারা আত্মপ্রচার করে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করেছে  এবং গণ্যমান্য লোকেদের চিঠি নোংরা ও অশ্লীল ভাষায় প্রকাশ করেছে ( আমি আশা করি আপনি স্বীকার করবেন যে 'ফাক' শব্দটি অশ্লীল এবং 'বাস্টার্ড' শব্দটি নোংরা, অন্তত এই বাক্যটিতে, "গাঙশালিক স্কুলের জারজদের ধর্ষণ করো", তারা এর চেয়েও খারাপ   ভাষায় কবিদের নাম উল্লেখ করে লিখতে ইতস্তত করেনি )। সম্প্রতি তারা একজন মহিলাকে ভাড়া করে তার উন্মুক্ত বুক দেখাবার প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল এবং সেই আশ্চর্যজনক আভাঁগার্দ প্রদর্শনী দেখার জন্য অনেকের সঙ্গে আমাকেও আহ্বান করেছিল । আপনি পৃথিবীর ওই পারে বসে কলকাতায় এই ধরণের বয়ঃসন্ধিকালীন ইয়ার্কিকে প্রচার করায় আপনার সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বলে চালাতে পারেন । আশা করি আমার যা দায়িত্ব তা পালন করার জন্য আপনি আমাকে আপনার মতের সঙ্গে পার্থক্য সমর্থন করবেন ।
          পুলিশের পক্ষে নিশ্চয়ই বোকামি হয়েছে এই যুবকদের গড়া ফাঁদে পড়ে তাদের কয়েকজনকে কয়েক দিনের জন্য হেফাজতে নেয়া ( তাদের সবাইকে এখন ছেড়ে দেয়া হয়েছে ) আর তার দ্বারা তাদের প্রচারে সুবিধা করে দেয়া এবং জনসাধারণের সহানুভূতি সংগ্রহ করা -- তারা তাদের ইয়ার্কির মাধ্যমে নিজেদের প্রচারই চাইছিল । 
          আপনার মতের সঙ্গে আমার এ-ব্যাপারে মিল নেই যে ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের প্রধান কাজ হলো মার্কিন বিটনিক কবিদের কাঁচা অনুকরণকারীদের সাহায্য করা । ইউরোপীয় সাহিত্য সম্পর্কে আপনার জ্ঞানকে আমি শ্রদ্ধা করি কিন্তু আমার ভাষার সাহিত্যকদের মূল্যায়ন করার ক্ষমতাকে আপনার নির্দেশে খর্ব করতে পারি না -- যে ভাষা সম্পর্কে আপনি নিজের অজ্ঞতা বেছে নিয়েছেন ।
          আপনার সঙ্গে গূঢ় পার্থক্য সত্ত্বেও এবং আপনার কয়েকটি অসাধারণ কবিতাকে ভালোলাগা সত্ত্বেও আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই ।
                                                                    ভবদীয়
                                                               আবু সয়ীদ আইয়ুব 

( অ্যালেন গিন্সবার্গ জানতেন না যে কলকাতা পুলিশে যাঁরা হাংরিদের বিরুদ্ধে নালিশ করেছেন তাঁদের মধ্যে শ্রী আইয়ুব অন্যতম । আইয়ুব তাঁর চিঠিতে গিন্সবার্গকে জানাচ্ছেন যে পুলিশ সবাইকে ছেড়ে দিয়েছে -- এটি ভুল তথ্য । মে ১৯৬৫ সালে পুলিশ সবাইকে রেহাই দিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর "প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" কবিতাটির জন্য অশ্লীলতার মামলা দায়ের করেছিল । নিম্ন আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর একমাসের কারা দণ্ডাদেশ হয়েছিল, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে । কলকাতা হাইকোর্টে মলয় মামলা জিতে যান জুলাই ১৯৬৭ সালে । অর্থাৎ মামলাটির জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে ৩৫ মাস আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছিল । )

মলয় রায়চৌধুরীর মামলায় সবচেয়ে ঘৃণ্য ও ক্ষমার অযোগ্য আচরণ করেছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ, হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা দিয়ে এবং আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে । মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে এই মামলায় পুলিশের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ।
         

সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৬

কবি ফালগুনী রায়ের শোকসভা

                                                                    Falguni Roy

মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

শৈলেশ্বর ঘোষ, তাঁর কুখ্যাত মুচলেকা

আমার নাম শৈলেশ্বর ঘোষ । আমার জন্ম বগুড়ায় আর বড়ো হয়েছি বালুরঘাটে। আমি ১৯৫৩ সনে বালুরঘাট হাই ইংলিশ স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি, ১৯৫৫ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে বিএ, আর ১৯৬২ সনে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলায় স্পেশাল অনার্স । ১৯৬৩ সনে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়া নামে একজন তাঁর হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে লিখতে বলেন । তারপরেই আমি হাংরি আন্দোনের লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হই । আমি ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতিমান লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র দত্ত, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী এবং উৎপলকুমার বসুকে চিনি । গত এপ্রিল মাসে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, এবং তিনি আমার কাছ থেকে কয়েকটা কবিতা চান । তাঁর কাছ থেকে আমি জানতে পারি যে, হাংরি বুলেটিনের একটা সংখ্যা খুব শীঘ্র প্রকাশিত হবে । মাসখানেক আগে আমি তাঁর কাছ থেকে একটা পার্সেল পেয়েছি । আমি মলয় রায়চৌধুরীকে চিনি । তিনি হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা । হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনে আমি মোটে দু'বার কবিতা লিখেছি । মলয় আমাকে কিছু লিফলেট আর দু'তিনটি পত্রিকা পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে কোনো নির্দেশ তিনি আমাকে দেননি । সাধারণত এইসব কাগজপত্র আমার ঘরেই থাকত । এটুকু ছাড়া হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আমি আর কুছু জানি না । অশ্লীল ভাষায় লেখা আমার আদর্শ নয় । ১৯৬২ থেকে আমি হুগলি জেলার ভদ্রকালীতে ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়ে স্কুল টিচার । মাইনে পাই দুশো দশ টাকা । বর্তমান সংখ্যা হাংরি বুলেটিনের প্রকাশের পর, যা কিনা আমার অজান্তে ও বিনা অনুমতিতে ছাপা হয়, আমি এই সংস্হার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছি । ভবিষ্যতে আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখব না, এবং হাংরি পত্রিকায় লিখব না । বর্তমান বুলেটিনটি ছাপিয়েছেন প্রদীপ চৌধুরী ।
                                                                 স্বাক্ষর : শৈলেশ্বর ঘোষ
                                                                 ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪

( শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি মামলায় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, এবং আদালতের ট্রেজারি থেকে রাজসাক্ষীর প্রাপ্য টাকাও নিয়েছিলেন । নিজের স্খলনকে লুকোবার উদ্দেশে তিনি অবিরাম মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে লিখে গেছেন । নিজের পরিবারের সদস্যদেরও মলয় রায়চৌধুরী-বিরোধী তৈরি করে গেছেন । পরবর্তীকালে 'দে'জ থেকে যে হাংরি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এমন বহু ভুয়ো লেখকের রচনা আছে যারা হাংরি আন্দোলনের সময়ে জন্মায়নি । )